বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর প্রথম শহীদ কে? প্রশ্নটি উঠলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুক ও দুই হাত প্রশস্ত করে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অকুতোভয় এক যুবকের ছবি।
বলছি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ রংপুরের আবু সাঈদ এর কথা।
আবু সাঈদ এর বাড়ি কোথায়?
জন্ম পরিচয় : আবু সাঈদ এর বাড়ি রংপুর জেলার, পীরগঞ্জ উপজেলার জাফর পাড়া গ্রাম।
দরিদ্র পিতা মকবুল হোসেন ও মাতা মনোয়ারা বেগমের নয় সন্তানের মধ্যে আবু সাঈদ সবার ছোট।
আবু সাঈদ বাল্যকাল থেকে তার মেধার স্বাক্ষর রেখে আসছেন, পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, এস এস সি তে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ,এইচএসসিতে রংপুর সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ ফাইভ। এবং সর্বশেষ রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২ তম ব্যাচে ভর্তি হন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪ :
২০১৮ সালের কোটা নিয়ে জারি করা সরকারের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ, ২০২৪ সালের ৫ এ জুন।
এরই পরিপেক্ষিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ জায়গা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন :
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে আরো বেগমান করতে ১ জুলাই ২০২৪ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর ব্যানারে একটি সংগঠন এর যাত্রা হয়।
কোটা আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে ৩ই আগস্ট সংগঠনটি বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১৫৮ জন সদস্যের সমন্বয়ে একটি সমন্বয় দল গঠন করে।
আবু সাইদ ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক।
বাংলা ব্লকেড : ৬ জুলাই শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে, দেশের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য সেরকম মহাসড়ক অবরোধ করে “বাংলা ব্লকেড” কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। আবু সাঈদ রংপুরে এ কর্মসূচি পালন করেন।
স্লোগান মুখর কোটা আন্দোলন : ১৪ জুলাই সাংবাদিকের করা এক প্রশ্নের জবাবে, প্রধানমন্ত্রীর উস্কানি মূলক জবাবে:
কোটা আন্দোলন নিয়ে কথা ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্লোগান
“ কোটা মুক্তিযোদ্ধা নাতিপুতিরা পাবে না তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে”
এরপর পরপরই কোটা আন্দোলনকারীদের নানা স্লোগানে রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
“তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার”
“চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার”
“তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার কে বলেছে কে বলেছে সরকার সরকার /স্বৈরাচার স্বৈরাচার ”
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে, রাজপথ সর্বত্র আন্দোলন দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে চলে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ আরও একজনের মৃত্যু
আবু সাঈদ সোশ্যাল মিডিয়া ও রাজপথ দুই জায়গায় ছিলেন সক্রিয়। ১৫ জুলাই আবু সাইদ তার ফেসবুকে, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে, ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার কবরের ফলকের ছবি দিয়ে পোস্ট করেন :
“স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার!
আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিল সবই তো মরে গেছে। কিন্তু আপনি মরে অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা সম্পূর্ণ একমত, উদ্ভাসিত।
এই প্রজন্মে যারা আছেন, আপনারা প্রকৃতির নিয়ম এক সময় মারা যাবেন, কিন্তু যতদিন বেঁচে আছেন, মেরুদন্ড নিয়ে বাঁচুন। নায্য দাবিকে সমর্থন জানান। রাস্তায় নামুন। শিক্ষার্থীদের ঢাল হয়ে দাঁড়ান। প্রকৃত সম্মান এবং শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সাথে সাথেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজ আম্মু বেঁচে থাকবেন শামসুজ্জ হয়ে।
অন্তত একজন “শামসজ্জোহা” হয় মরে যাওয়া টা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের”
আবু সাঈদের মৃত্যু ও চূড়ান্ত বিজয়
১৬ জুলাই আন্দোলন আরও কঠিন থেকে কঠিনতর আকার ধারণ করে। সরকার পুলিশ ও ছাত্রলীগ নামক পেটোয়া বাহিনী দ্বারা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নির্যাতন শুরু করে।
দুপুর ১২ঃ০০ টায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে অঞ্চলে কোটা আন্দোলন কর্মীরা যখন বিক্ষোভ করছিল, আবু সাঈদ এ আন্দোলনের সম্মুখভাগে ছিলেন।অস্ত্রশস্ত্রে সাজ্জিত পুলিশ বাহিনী ছাত্রদের উপরে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলে। আন্দোলন কর্মীরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যান।কিন্তু নির্ভীক আবু সাঈদ দুহাত প্রসারিত করে একা দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় মানুষরূপী পুলিশের একের পর এক ছোড়া রাবার বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আবু সাঈদ।হাসপাতালে নেওয়ার আগেই
মৃত্যু হয় তার।
আবু সাঈদ এর মৃত্যুর এই নির্মম দৃশ্য,সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়ার সাথে সাথে,দেশের সর্বস্তরের জনগণ বিশেষত সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সমাজ একসাথে সরকার পতনের এক দফা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। যারই ফলে ৫ ই আগস্ট বাংলাদেশে নতুনভাবে স্বাধীন হয়।
আবু সাঈদ স্মরণে : দেশের জন্য আবু সাঈদের নিজের জীবনের এই ত্যাগকে স্মরণ করে রাখতে। রংপুর পার্ক মোড়ের নাম পরিবর্তন করে “আবু সাঈদ চত্বর ”
ও রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটের নাম “শহীদ আবু সাঈদ গেট” নামকরণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আবু সাঈদের মৃত্যুকে বরণ করার আগে দুই হাত প্রসারিত ছবিসহ গেঞ্জি ও দেখা যায়।
দেশের ক্রান্তিলগ্নে আবু সাঈদেরা নানা রূপে নানা নামে বারবার ফিরে আসে। তাদের শারীরিক মৃত্যু হয় শুধু,কিন্তু তাদের আদর্শ, চিন্তা চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়..…….